গ্রামের একাংশের মেয়েদের ঠিকানা কেয়ার অফ যৌনপল্লী। সব জেনেশুনেও, বছরের পর বছর ধরে চলে আসা প্রথা ঠেকাতে নিরুত্তাপ প্রশাসন। কলকাতার প্রভাবশালী পত্রিকা এই সময়ের প্রতিবেদন।
কুলতলি ব্লকে ঢোকার মুখেই জামতলা মোড়। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার পাকা রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলে ডুবে যাওয়া মাঠঘাট আর পথের এক প্রান্তে জেগে আছে গ্রামটা। এমনিতে আর পাঁচটা গ্রামের সঙ্গে বিশেষ ফারাক নেই। ইঁট মাটির ভাঙা-ভাঙা রাস্তা। তস্য জীর্ণ বাড়িঘর। বর্ষায় ডুবে থাকা চাষের খেত।
তবু আর পাঁচটা গ্রামের থেকে আলাদা এই গ্রাম। আলাদা তার চরিত্রে। বছরের পর বছর এই গ্রামের মেয়েরা পেটের টানে পা দেয় যৌনপল্লীর অন্ধকার গলিতে। হিসেব কষলে দেখা যাবে, গ্রামের বহু পরিবারেরই কোনো না কোনো মহিলার ঠিকানা কেয়ার অফ সোনাগাছি। আড়ালে আবডালে নয়। প্রকাশ্যে এই প্রথা চললেও মেয়েদের সেখানে যাওয়া ঠেকাতে নিরুত্তাপ প্রশাসন।
‘এ গ্রামে মেয়ে হারিয়ে যায় না। বাবা-মায়েরা মেয়েদের ছোট্ট বেলায় বিয়ে দেয়। তারপর প্রার্থনা করে, মেয়েরা যেন শ্বশুর ঘর থেকে ফিরে আসে। ফিরে এলেই গ্রামের অন্যকোনো মেয়ে মারফত তাঁদের পাঠিয়ে দেয় সোনাগাছিতে। তারা রোজগার করে আনে। আর গোটা পরিবারের পেট চলে,’ নিজের অফিসে বসে কথাগুলি বলেছিলেন মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তি।
কিন্তু, সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক কতটা?
জানতে ঢুঁ মারা গেল গ্রামের বেশ কিছু বাড়ির অন্দরমহলে। কথা হচ্ছিল অনন্তবালা মণ্ডলের সঙ্গে। মধ্যবয়স্ক এই মহিলার তিন ননদই যুক্ত ছিলেন যৌন ব্যবসার সঙ্গে। প্রত্যেকেই জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়েছেন সোনাগছিতে। অনন্তবালাদেবীর কথায়, ‘প্রথমে বড় ননদ যান। তার পর স্বামী পরিত্যক্তা আরও দুই ননদও চলে যান। এক ননদের মেয়েও যৌন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সম্প্রতি এইডস-এ আক্রান্ত হয়ে সেই ভাগ্নির মৃত্যু হয়েছে।
পরিবার মেনে নিয়েছিল?
প্রশ্নের উত্তরে খানিক থমকান বড় রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকান চালানো অনন্তবালা। জানান, ‘আর্থিক সঙ্গতি না থাকার কারণেই পরিবার মেনে নিয়েছিল। শুধু আমাদের কেন, এখানকার অধিকাংশ পরিবারই সেটা মেনে নেয়।’
শুধু পরিবার নয়। মেনে নেন, গ্রামের ‘মোড়লরাও’। তাই গ্রামের মেয়ের যৌনবৃত্তির টাকায় এ গ্রামে গড়ে ওঠে প্রাইমারি স্কুল, মন্দির। ‘বছর পঞ্চাশ আগে গ্রামের যে মহিলা প্রথম যৌনপেশায় চলে গিয়েছিলেন, তাঁরই টাকায় এই স্কুল তৈরি হয়েছে,’ জানান গ্রামেরই আর এক বাসিন্দা মাধব সাঁধুখা। সময় বদলেছে। বদলেছে, সোনাগাছির প্রতি আসক্তিও। বদলে দিল্লি এবং মুম্বাইতে গিয়ে যৌন ব্যবসায় নামছেন এই গ্রামের মহিলারা। যেমন, সম্প্রতি অনন্তবালার এক ভাগ্নে বউ চলে গিয়েছেন মুম্বাইতে। স্বামীর আপত্তি থাকলেও, মা-বাবার প্রশ্রয় পেয়েছে সে। ‘ওর আর এক বোনও মুম্বাইতে কাজ করে। মেয়েরা গ্রামে ফিরলেই অনেক টাকা, সোনাদানা নিয়ে আসে দেখে বাবা আমাদের ভাগ্নে বউকেও ছেড়ে দিয়েছে।’
তবে সুখের কথা হলো, খুব ধীর লয়ে হলেও প্রথা বদলাচ্ছে এই গ্রামের। নিজের মা-মাসি-পিসিকে যৌনপল্লীতে খাটতে দেখা অনেক পরিবারের বর্তমান প্রজন্মই এখন আর নিজের মেয়েকে যৌনপল্লীর অন্ধকারে ঠেলতে চাইছেন না। যদিও, নাবালিকা বিয়ে বন্ধ হয়নি এখানে। স্থানীয় এক মহিলার কথায়, ‘গত কয়েক বছরে সোনাগাছিতে পাঠানোর সংখ্যা কমলেও, বাচ্চা মেয়েদের বিয়ের সংখ্যা ভয়ানক বেড়ে গিয়েছে। আমার পাশের বাড়িরই মেয়েটাকে কত ছোটবেলায় বিয়ে দিয়ে দিলো।’
এই গ্রামের সামান্যতম পরিবর্তনে অবশ্য বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই রাজ্য প্রশাসনের। পাঁচ-সাত দশক ধরে চলা এই প্রথা ঠেকাতে এ গ্রামের মেয়েদের জন্য না কোনো বিশেষ প্যাকেজ, না কোনো কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে সরকারি তরফে। যেটুকু চেষ্টা চরিত্র হয়েছে, তা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তাগিদেই। পরিস্থিতি এমনই যে কুলতলি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শ্যামপদ নাইয়ার গলা থেকেও উগড়ে আসে ক্ষোভ। জানান, ‘পরিস্থিতি একটু বদলেছে ঠিকই। কিন্তু, সরকারি সাহায্য ছাড়া এর বেশি উন্নতি হওয়া সম্ভব নয়। পেটে টান পড়লেই আবার যে কে সেই অবস্থা হয়ে যাবে। সরকার তো আমাদের পঞ্চায়েত সমিতির প্রাপ্য টাকাই দিতে চায় না। ওদের বাড়তি সাহায্য করব কি ভাবে?